ফরজ নামাজের পর বিভিন্ন তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পড়ার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
ফরজ নামাজের পর বিভিন্ন তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পড়ার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
আপনারা যারা "ফরজ নামাজের পর বিভিন্ন তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পড়ার গুরুত্ব ও ফজিলত" সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। তাহলে, আজকের পোস্টটি আপনাদের জন্য। কেননা আজকের পোস্টে আপনারা জানতে পারবেন, কেন ফরজ নামাজের পর তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পড়া উচিত, এর পেছনের হাদিসসমূহ কী বলে, এবং কীভাবে আপনি প্রতিদিনের রুটিনে সহজে এই যিকিরগুলো যুক্ত করতে পারেন।
ভূমিকাঃ
ইসলামে নামাজের পর তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পাঠ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ আমল।প্রতিদিনের ফরজ নামাজগুলো শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালন নয়, বরং মুমিনের জীবনে আত্মিক প্রশান্তি ও দুনিয়া-আখিরাতের মুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু জানেন কি, নামাজ শেষ করার পর যে ছোট ছোট দোয়া, তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পড়া হয়, সেগুলোর ফজিলত কত গভীর ও বিস্ময়কর? অনেকেই হয়তো নামাজ শেষেই উঠে যান কিংবা তাড়াহুড়োয় ভুলে যান এই দামী আমলগুলো। অথচ এই কয়েক মিনিটের যিকির হতে পারে আপনার জীবনের বড় সুরক্ষা।
তাসবীহ ফাতিমা, আয়াতুল কুরসি, সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস— এসব ছোট অথচ অর্থপূর্ণ যিকির রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে আমল করতেন এবং সাহাবীদেরও আমল করতে উৎসাহ দিতেন। এগুলো শুধু গোনাহ মাফের বাহন নয়, বরং দুনিয়ার বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা ও কিয়ামতের দিন বিশেষ সওয়াবের কারণ হয়।
এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব- কেন ফরজ নামাজের পর তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পড়া উচিত, এর পেছনের হাদিসসমূহ কী বলে, এবং কীভাবে আপনি প্রতিদিনের রুটিনে সহজে এই যিকিরগুলো যুক্ত করতে পারেন।
হাদিস ও কুরআনের আলোকে ফরজ নামাজের পর এসব আমলের গুরুত্ব ও উপকারিতা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
আরো পাড়ুনঃ সোশ্যাল মিডিয়ার আয়ের ফেতনা (হক্ব ও গীবত) সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
নামাজের পর দোয়া ও তাসবীহ পড়ার গুরুত্বঃ
ফরজ নামাজ আদায়ের পর দোয়া ও তাসবীহ পাঠ ইসলামী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। ফরজ নামাজ শেষে দোয়া ও তাসবীহ পাঠ করা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম উপায়। এতে একদিকে যেমন ইবাদত সম্পূর্ণতা পায়, অন্যদিকে অন্তর প্রশান্ত হয় এবং গুনাহ মাফের সুযোগ তৈরি হয়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়মিত নামাজের পর কিছু নির্দিষ্ট তাসবীহ, যেমন "সুবহানআল্লাহ", "আলহামদুলিল্লাহ", "আল্লাহু আকবার" - এই ত্রিশবার বা তেত্রিশবার করে পাঠ করতেন ও দোয়া করতেন এবং সাহাবাদেরও করতে বলতেন। এতে জান্নাত লাভের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এই সব তাসবীহ ও দোয়া অন্তরকে শুদ্ধ করে, আল্লাহর স্মরণ বৃদ্ধি করে এবং রিজিক বাড়ার ও বিপদ থেকে বাঁচার মাধ্যম হয়। সুতরাং, প্রতিটি ফরজ নামাজের পর দোয়া ও তাসবীহ পাঠ করা মুসলমানদের জন্য এক অতুলনীয় ফজিলতের কাজ।
হাদিস থেকে প্রমাণঃ
১। জিকিরের মর্যাদাঃ
জিকির অর্থ আল্লাহকে স্মরণ করা। এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা মুসলমানের হৃদয়কে শুদ্ধ করে, আত্মাকে প্রশান্ত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রধান মাধ্যম। কুরআন ও হাদীসে জিকিরের অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
"তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদের স্মরণ করবো" (সূরা বাকারা: ১৫২)।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
আল্লাহর জিকির এমন একটি আমল যা সবচেয়ে সহজ অথচ সবচেয়ে বেশি সাওয়াবের কাজ। "যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাসবীহ, হামদ, তাকবীর ও তাহলীল (সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) পাঠ করবে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমান হয়।" (সহিহ মুসলিম: ৫৯৭)
জিকির মানুষের পাপ মোচন করে, অন্তরে ঈমান জাগ্রত করে এবং জান্নাতের পথে সহায়ক হয়। যেসব মানুষ অধিক জিকির করে, তাদেরকে কুরআনে "আল্লাহর প্রিয় বান্দা" বলা হয়েছে।
সারসংক্ষেপে, জিকির এমন এক পুণ্যময় আমল যা মুসলমানকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত রাখে, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ আনে এবং জীবনের প্রতিটি কাজে বরকত সৃষ্টি করে।
২। তাসবীহ পড়ার ফজিলতঃ
এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
"যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার এবং ১ বার 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ও হুয়া আলা কুল্লি শাইইন কাদির' পাঠ করবে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার মতো হয়।"
(সহিহ মুসলিম: ৫৯৭)
ফরজ নামাজের পর পড়ার জন্য নির্ধারিত তাসবীহ ও জিকির
প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর নিম্নলিখিত দোয়া ও তাসবীহ পাঠ করা সুন্নতঃ
১। আস্তাগফিরুল্লাহ (৩ বার)
অর্থঃ "আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।"
২। আয়াতুল কুরসি (সূরা বাকারা ২:২৫৫)
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
"যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পড়বে, তার জান্নাতে প্রবেশে কেবল মৃত্যুই বাধা হয়ে থাকবে।"
(সুনানে নাসাঈ: ৯৯২৮)
৩। সুবহানাল্লাহ (৩৩ বার)
অর্থঃ "আল্লাহ পবিত্র।"
৪। আলহামদুলিল্লাহ (৩৩ বার)
অর্থঃ "সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।"
৫। আল্লাহু আকবার (৩৩ বার)
অর্থঃ "আল্লাহ মহান।"
৬। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ও হুয়া আলা কুল্লি শাইইন কাদির (১ বার)
অর্থঃ "আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরীক নেই, সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রশংসা তাঁরই জন্য, এবং তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।"
আরো পাড়ুনঃ কখন কখন দরুদ শরীফ পাঠ করা উত্তম? সময় ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত গাইডলাইন জেনে নিন।
আয়াতুল কুরসি পড়ার ফজিলতঃ
১। জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চয়তাঃ
হাদিসে বর্ণিত আছেঃ
"যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পড়বে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।"
(সুনানে নাসাঈ: ৯৯২৮)
জান্নাত হলো আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য প্রস্তুত করা চিরস্থায়ী পুরস্কার। একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নই হলো জান্নাতে প্রবেশ করা। কিন্তু এই জান্নাত লাভ করতে হলে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হয়।
জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চয়তা পেতে হলে ঈমান আনতে হবে, নিয়মিত নামাজ আদায় করতে হবে, হালাল-হারাম মেনে চলতে হবে, ভালো কাজ করতে হবে এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মনেপ্রাণে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে মৃত্যুবরণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
তবে শুধু মুখের কথা নয়, আমলেই এর প্রমাণ দিতে হয়। আল্লাহর ভয়, দয়া, ধৈর্য, দানশীলতা ও সৎ চরিত্র জান্নাতের নিশ্চয়তার পথ তৈরি করে।
সারাংশ, জান্নাতের নিশ্চয়তা পেতে হলে বিশ্বাস, আমল ও আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা রেখে ধার্মিক জীবনযাপন করতে হবে। তখনই মিলবে সেই অনন্ত সুখের আবাসস্থল – জান্নাত।
২। শয়তান থেকে হিফাজতঃ
"যে ব্যক্তি আয়াতুল কুরসি রাতে ঘুমানোর আগে পড়ে, সে রাতে শয়তান তার ক্ষতি করতে পারবে না।"
(সহিহ বুখারি: ৩২৭৫)
শয়তান মানুষকে গোমরাহ করার জন্য চিরশত্রু। সে সবসময় চায় মানুষ আল্লাহর পথ থেকে সরে গিয়ে পাপের পথে চলুক। তাই একজন মুসলমানের জন্য শয়তানের প্রভাব থেকে হিফাজত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায় হলো আল্লাহর স্মরণ (জিকির), কুরআন তিলাওয়াত, নামাজ আদায়, সৎ কাজের প্রতি মনোযোগ এবং খারাপ চিন্তা ও কাজ থেকে দূরে থাকা। বিশেষ করে “আঊজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম” পড়া, আয়াতুল কুরসি ও সূরা ফালাক-নাস নিয়মিত পড়া শয়তান থেকে হেফাজতের শক্তিশালী অস্ত্র।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় কিছু নির্দিষ্ট দোয়া পড়ে, শয়তান তার কাছেও আসতে পারে না।
সারসংক্ষেপ, শয়তান থেকে হিফাজত পেতে হলে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে, নিয়মিত ইবাদত ও জিকিরের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে সুরক্ষিত রাখতে হবে - যাতে সে আমাদেরকে ভুলপথে নিতে না পারে।
৩। দোয়া কবুল হওয়াঃ
"যে ব্যক্তি ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পড়ে, তার দোয়া কবুল হয় এবং আল্লাহ তাকে নিজের হেফাজতে রাখেন।" (মুসলিম শরিফ)
দোয়া হলো বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর দরবারে চাওয়ার মাধ্যম। এটি ইবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং মু’মিনের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন, “তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব” (সূরা গাফির: ৬০)।
দোয়া কবুল হওয়ার জন্য কিছু শর্ত ও আদব রয়েছে— যেমন: হালাল রিজিক গ্রহণ করা, ধৈর্য সহকারে দোয়া করা, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং মনোযোগ দিয়ে চাওয়া। এছাড়া কিছু বিশেষ সময়েও দোয়া কবুল হয়, যেমন: তাহাজ্জুদ, জুমার দিন, রোজাদারের ইফতারের সময়, আজান ও ইকামতের মাঝে ইত্যাদি।
দোয়া কখনো সরাসরি কবুল হয়, কখনো বিলম্বিত হয়, আবার কখনো দোয়ার বদলে অন্য কোনো বিপদ দূর করে দেওয়া হয়। তাই মুমিনের উচিত হতাশ না হয়ে বারবার দোয়া করা।
সারাংশ, দোয়া হলো আল্লাহর সাথে সম্পর্কের গভীরতম প্রকাশ, যা বান্দাকে তাঁর করুণা ও রহমতের ছায়ায় নিয়ে আসে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ এনে দেয়।
আরো পাড়ুনঃ নামাজে যে ১০টি ভুল অনেকেই করে থাকেন - মুসলমানদের জন্য জরুরি সতর্কতা।
উপসংহারঃ
প্রিয় পাঠকগণ, আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন, ফরজ নামাজের পর তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসি পাঠ করা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল। এটি যেমন গুনাহ মাফের মাধ্যম, তেমনি জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম সহজ পথ। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর এই আমলগুলো করা আমাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী ও কল্যাণকর। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
যাই হোক যদি কোন মন্তব্য থেকে থাকে তবে কমেন্ট করে জানাবেন এবং আজকের আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url